Khoborerchokh logo

বীরত্বগাঁথা শহীদ বুদ্ধিজীবী প্যারী মোহন আদিত্যের ৫১তম মৃত্যুবাষির্কী,এখন শুধুই স্মৃতি ! 334 0

Khoborerchokh logo

বীরত্বগাঁথা শহীদ বুদ্ধিজীবী প্যারী মোহন আদিত্যের ৫১তম মৃত্যুবাষির্কী,এখন শুধুই স্মৃতি !

আলমগীর কবীর:

টাঙ্গাইল জেলার ঘাটাইল উপজেলাধীন পাকুটিয়া গ্রামের ৫ জুন ১৯৩৪ সালে ঐতিহ‌্যবাহী আদিত‌্য পরিবারে যার জন্ম । গর্ভধারিণী মহামায়া ও মুকন্দ আদিত‌্যের চার সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয় ডানপিঠে শহীদ বুদ্ধিজীবী প্যারী মোহন আদিত‌্য । ছোটবেলা থেকেই চলাফেরা,কথা বলার ধরণ,নম্রতা ভদ্রতা,বড়দের প্রতি শ্রদ্ধাবনত,ইত্যাদি ছিল তার চরিত্রের বৈশিষ্ঠ্য । গ্রামের ধুলোবালি,মেঠোপথ,এ বাড়ি ওবাড়ি চষে বেঁড়ানো সেই ছেলেটি আস্তে আস্তে বড় হয়ে প্রাইমারী স্কুলে পড়াশুনা । প্রাইমারী স্কুলের গন্ডি পার হয়ে হাইস্কুলে পড়াশুনা কালিন সময়ে অত্র এলাকার স্কুল শিক্ষকসহ বয়োজ্যেষ্ঠদের অতি আদরের,গ্রামের মানুষের নজরে আসতে শুরু করলো কৈশোর প্যারী মোহন আদিত্য । কৈশোর জীবনে আসে তার আমুল পরিবর্তন, তখন থেকেই ছড়া,গান,কবিতা,ছোট গল্প লেখা,ধর্ম জ্ঞানচর্চা,ইত্যাদি ছিল তার নিত্যনৈমিত্তিক ‍ রুটিন মাফিক কাজ। এভাবেই কাটতে থাকলো জীবনের কয়েকটি বছর । একটা পর্যায়ে মা বাবার আদেশে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন প্যারীমোহন আদিত্য ।


 জীবন চলচ্ছে জীবনের গতিতে,ইতিমধ্যে পিতৃহারা,মাতৃহারা হয়েছেন । সংসারের দায়ভার নিতে হয়েছে তাকে । তখনো দেশ ভাগ হয়নি,আমাদের এই অঞ্চলের নামকরণ ছিল পূর্ব পাকিস্তান । ১৯৪৭সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার পর পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে ব্যবসা বানিজ্য,কর্মক্ষেত্রসহ নানা বিষয়ে বৈষম্য দেখা দিতে শুরু করলো । পশ্চিম পাকিস্তানীরা পূর্ব পাকিস্তানীদের উপর বৈসম্যের পাশাপাশি জুলুম নির্যাতন শুরু করলো এবং সেটা ছির লাগাতার । অন্যায় অত্যাচার আর জুলুম নির্যাতন সহ্য করতে করতে পূর্ব পাকিস্তানে বসবাসকারীরা এক সময় ফুলেফেঁপে উঠতে শুরু করলো ।


এরই মাঝে ৫২‘র ভাষা আন্দোলন,৬৯ ‘র গণ অভ্যুত্থানসহ অনেক কিছুতেই সরাসরি অংশগ্রহন করেছিলেন প্যারীমোহন আদিত্য । দেশের অস্থিতিশীল অবস্থা চলমান,পূর্ব পাকিস্তান এর সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের থমথমে অবস্থা,পূর্বপাকিস্তানের ছোট বড় বৃদ্ধ বনিতা সকলেই যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিল । বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দফায় দফায় মিছিল মিটিং এবং সুসংগটিত হওয়ার
মহা পরিকল্পনা চলছিল । এদিকে ৫২‘র ভাষা আন্দোলনে এবং ৬৯‘র গণঅভ্যুত্থানে সরাসরি অংশ নেওয়া আদিত্য মনে মনে স্থীর করলেন,দেশ ও দেশের মানুষের কল্যানে নিজেকে সপে দিবেন ।মুক্তিকামী মানুষদের সাথে যখন যেখানে যা প্রয়োজন,সাধ্যমত সরবরাহ শুরু করলেন ।


 সেই সময়ে দেশে যুদ্ধ চলাকালিন এ অবস্থায় কোন ডকুমেন্ট সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি।
একদিকে ছেলে মেয়ের লেখাপড়া,সাংসারিক চাপ,মুক্তিযোদ্ধাদের যোগানদাতা,জীবন মরণের  অনিশ্চয়তা, টাঙ্গাইলসহ পুরো পূর্বপাকিস্তানের মানুষ ছিল ভয়ে তটস্থ। অদম্য সাহসী,জ্ঞানগর্ভের অধিকারী,মুক্তিকামী যোদ্ধা,আলোর দিশারী,অকুতোভয় প্যারী মোহন আদিত্য দেশ প্রেমে নিজেকে উজার করে জীবন বাজি রেখে চলেছিলেন বীরদর্পে ।

১৯৭১ সালের মার্চ মাস,
 পশ্চিম পাকিস্তানী হানাদারদের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তিকামী মানুষের যুদ্ধ শুরু হলো পুরোদমে । পুরো এলাকা জুড়ে ধ্বংস যজ্ঞের তান্ডব । এহেন সময়ে প্যারী মোহন আদিত্য ছিলেন একটি পত্রিকার সহ সম্পাদকের দায়িত্বে। গোপনে গোপনে পূর্ব বাঙ্গলার মুক্তিকামীদের সার্বিক সহযোগিতা,মুক্তিকামীদের আশ্রয়দাতা, মন্দিরে মন্দিরে পূজা অর্চনা করা ।এভাবেই চলছিল দিনকাল ।




১৯৭১ সালের ১৮ এপ্রিল পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী টাঙ্গাইল থেকে ময়মনসিংহের দিকে ধবংস যজ্ঞ চালাতে চালাতে যাচ্ছিল । তাদের কাছে গোপন তথ্য ছিল এই আশ্রমে মুক্তিকামীদের যাওয়া আসা আছে । মুক্তিবাহিনীর গোপন মিটিং হয় এখানে,সেই লক্ষেই পাক হানাদার বাহিনীর ঘাতকরা মর্টার শেল নিক্ষেপ করেছিল এই আশ্রমে । সেই সময়ে বিভৎস চিত্র দেখে জীবন রক্ষার্থে প্যারী মোহন আদিত্য দিকবিদিক না ভেবেই আশ্রয় নেন শ্রীশ্রী ঠাকুর আশ্রমের সন্মুখে ভাগে । সেখানে তিনি নি:সঙ্গ চিত্তে ধ্যানমগ্ন হয়ে সৃষ্টিকর্তার নিকট করেন । ঐসময়ে হানাদার বাহিনীর মর্টার শেলের আঘাতে মন্দিরের চূড়া চূর্ণবিচূর্ণ হয়েছিল  । আমপাশের এলাকার ঘরবাড়িতে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছিল । প্যারীমোহন আদিত্যের ধ্যানমগ্ন অবস্থান ছিল প্রকৃত প্রতিকৃতির ন্যায় । ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর পর ময়মনসিংহ অভিমুখে চলে যায় ঘাতক হানাদার বাহিনী । সে যাত্রায় বেঁচে যান আদিত্য ।

দিনের পর দিন ধ্বংস যজ্ঞ চলমান,গ্রামে গ্রামে পাড়া মহল্লায় মুক্তিকামী মানুষের আর্তনাদ,বিভীষিকাময় দৃশ্য চারিদিকে ।
২১ মে ১৯৭১ সাল সময় আনুমানিক সকাল ৯.০০ঘটিকা । পূর্বসূত্র মতে দেশীয় ঘাতক,দালাল,আলবদর রাজাকাদের নিকট জানাশুনা ছিল মুক্তিকামীদের সহায়তাকারী,হিন্দু ধর্মালম্বী,প্যারী মোহন আদিত্য সকাল সকাল মন্দিরে পূজা অর্চনা করেন । ঐদিন পশ্চিম পাকিস্তানী হানাদারদের তথ্য দিয়েছিল,দালালরা ।
সেই তথ্যমতে ঘাটাইলের পাকুটিয়া এলাকায় আক্রমন চালায় তারা । একটা পর্যায়ে হনাদাররা জানতে পারে প্যারী মোহন আদিত্য মন্দিরে পূজারত অবস্থায় ধ্যানমগ্ন আছেন । মন্দিরের চারিদিকে ঘিরে রাখে হানাদাররা । কয়েকজন
মন্দিরে প্রবেশ করে প্যারী মোহনকে উপুর্যপুরী আঘাত করে এবং হাত পা বেধেঁ ঘাটাইল ক্যাম্পে নিয়ে যায় । ক্যাম্পে নিয়ে নির্যাতন করার পর মৃত্যু নিশ্চিত হয়েছে ভেবে প্যারী মোহনকে মাটিতে শুইয়ে রাখা হয় । সৃষ্টিকর্তার অশেষ কৃপায় বেঁচে ছিলেন এবং রাতের অন্ধকারে হানাদারদের ফাঁকি দিয়ে কৌশলে ক্যাম্প থেকে পলায়ন করেন । সৃষ্টিকর্তার কৃপায় দ্বিতীয় যাত্রায়ও বেঁচে যান প্যারী মোহন আদিত্য ।
পরিশেষে ৮ আগস্ট,রবিবার ১৯৭১ সাল,প্যারী মোহন আদিত্যের সহযোদ্ধারা অনেকেই পালিয়েছে এলাকা ছেড়ে,। কেউ কেউ অন্যত্রে চলে গিয়েছে । কেউ কেউ শহীদ হয়েছে হানাদারদের বেয়নটের আঘাতে । অনেকেই পঙ্গুত্ব বরণ করে ঘরের কোনায় কাতরাচ্ছে । নি:সঙ্গ,নিরুপায় প্যারী মোহন সৃষ্টিকর্তার নিকট প্রার্থনা করতে থাকেন । এহেন পরিস্থিতিতে রবিবার ৮ আগস্ট ১৯৭১ সাল বিকাল ৩.০০ ঘটিকায় ভাঙ্গা বিহম্বল মনে সৎসঙ্গ আশ্রমে যান । আশ্রমে ধ্যানমগ্নাবস্থায় ছিলেন প্যারী মোহন আদিত্য । সেই দিনটিই ছিল তার জীবনের অন্তিম ।


এদিকে পশ্চিম পাকিস্তানের দোসরদের পূর্ব তথ্য মোতাবেক হানাদার বাহিনীর ঘাতকরা পরপর দু-বার বেঁচে যাওয়া প্যারী মোহন আদিত্যকে ধ্যানমগ্নাবস্থায় পেয়ে সম্পূর্ণ শরীরে বেয়নটের আঘাতে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে ঘাতকরা ।

উল্লেখ্য; পরপর দু-বার বেঁচে যাওয়া প্যারী মোহন আদিত্যের উপর পূর্বের ক্ষোভ মেটাতে সম্পূর্ণ শরীরে এত বেশি আঘাত করেছিল যে তার মুখোমন্ডল,থেঁতলে নির্রাকার করেছিল,হাত পা ছিন্নবিছিন্ন করেছিল । শেষকৃতির,সৎকারের জন্য তার মরদেহটাও খুঁজে পায়নি প্যারী মোহনের আত্মীয় স্বজনরা ।
আজ স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরেওশহীদ প্যারী  মোহন আদিত্য শুধুই বিভীষিকাময়স্মৃতি ।



সরেজমিনে জানা যায়,


অত্র এলাকার জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ বেলায়েত হোসেন জানান,প্যারী  মোহন আদিত্য ছিলেন,সনাতন ধর্মে বিশ্বাসী,মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে মুক্তিকামী মানুষদের সার্বিক সহযোগীতা করেছিলেন । তার অকালে শহীদহওয়াটা অত্যন্ত দু:খজনক ।

মো: খোরশেদ আলম তালুকদার (বীরপ্রতীক) বীরপ্রতীক, যুদ্ধকালীন ১ নং হেড কোয়াটার কোম্পানী কমান্ডার, কাদেযীয়া বাহিনী। এই প্রতিবেদককে জানান, শহীদ প্যারীমোহন আদিত্য নি:সন্দেহে একজন ভাল মানুষ ছিলেন,সেই সময়ে পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে হানাদার বাহিনীর তান্ডবে এই এলাকার মানুষ ভয়ে তটস্থ ছিল । প্যারী মোহন তখন,আমাদেরকে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্নভাবে সহযোগীতা করেছেন ।

 বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ হযরত আলী বলেন,আদিত্য পরিবারের মধ্যে প্যারী মোহন ছিল ব্যতিক্রমী মানুষ,সে ছিল ধর্মকর্মে বিশ্বাসী,মন্দিরে মন্দিরে ধ্যনমগ্নে থাকতেন, সামাজিক কর্মকান্ডে ভাল ভূমিকা রাখতেন । মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে মুক্তিকামী মানুষদের পাশাপাশি থাকতেন এবং সার্বিক সহযোগীতা করেছিলেন॥ হানাদার পাকবাহিনীর লোকেদের রোসানলে পড়ে সে শহীদ হয়েছিলেন ।

 বীর মুক্তিযোদ্ধা মো: মতিয়ার রহমান খান- সাবেক ইউনিয়ন কমান্ডার বয়সেরভারে নুয়ে পড়েছেন,তার পৈত্রিক বাড়িতে এই প্রতিবেদক উপস্থিত হয়ে জানতে চান শহীদ প্যারী মোহন আদিত্য সম্পর্কে, উত্তরে কাঁন্না জড়িত কন্ঠে,আবেগাল্পাুত হয়ে পড়েন॥ তিনি বলেন,কেন দু:খের স্মৃতি ভাসালেন,প্যারী ছিল আমার অতি আদরের,খুব কাছের,ওর তুলনা হয় না । এক কথায় ছিল অমায়িক একটি ছেলে । ও যেমন ছিল, দেশপ্রেমিক, মুক্তিকামী মানৃুষের সহযোদ্ধা,কি কারণে হানাদাররা ওকে মারলো আমি জানি না । তবে ওকে যারা মেরেছে তাদের ভালো হবে না । ও স্বর্গবাসী হউক,সেই প্রত্যাশা করি ।

 বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ হাবিবুর রহমান - সাবেক থানা কমান্ডার এই প্রতিবেদকে জানান,আমাদের এই এলাকার গর্ব ছিল প্যারী মোহন আদিত্য । তৎকালীন সময়ে তার শহিদী মৃত্যু না হলে এই এলাকার মানুষ অনেক কিছু পেত । প্যারী মোহন আদিত্য ছিল উচ্চতর মনের অধিকারী । প্যারী মোহন আদিত্য স্বর্গবাসী হউক এই প্রত্যাশা করি ।

কুঞ্জ বিহারী আদিত্য-লেখক:  সভাপতি, সৎসঙ্গ বাংলাদেশ,প্যারী মোহন আদিত্য দাদা সম্পর্কে বলতে গেলে চোখে জল এসে যায়,পিতৃতুল্য দাদা । আমি তখন ছোট ছিলাম । আমাদের অনেক আদর করতেন । যুদ্ধকালীন সময়ে হানাদারদের বেয়োনটের আঘাতে তার মৃত্যুর কথা ভীষনভাবে কাঁদায় ।

 প্যারী মোহন আদিত্যের বন্ধু আব্দুল জলিল জানান,শহীদ প্যারী মোহন আদিত্য ছিল আমার ভাল বন্ধু ।তার গুন বিচার করার মত ব্যাখ্যা দিতে গেলে কয়েকদিন লেগে যাবে । তারপরেও শেষ হবে না । তবে একটি কথা বলবো,সে ছিল উত্তম চরিত্রের অধিকারী,সমাজ সেবক,মানব পূজারী ।প্যারীর  শহিদী আত্মত্যাগের বেদনা একনো পিড়া দেয় ।

 তুলসি আদিত্য বলেন,প্যারী মোহন আদিত্য একটি নাম,তিনি ছিলেন,একাধারে দেশ প্রেমিক,সমাজ সেবক,মুক্তিযোদ্ধাদের বন্ধু । তিনি অত্যন্ত ভাল মানুষ ছিলেন।
মন্টু আদিত্য- অত্র এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা জানান,একজন ভাল মানুষের যতগুলো গুন থাকা দরকার,তার সবগুলোই বিদ্যমান ছিল তার মধ্যে । প্যরী মোহন ছিল আমার খুব ঘনিষ্ট বন্ধু ।


সম্পাদকঃ আলমগীর কবীর, ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মনিরুজ্জামান। উপদেষ্টা সম্পাদক পরিষদঃ শাহিন বাবু । অস্থায়ী কার্যালয়ঃ নাওজোড়, বাসন, গাজীপুর মেট্রো পলিটন, গাজীপুর।
যোগাযোগঃ ০১৭১১৪২১৪৫১, ০১৯১১৮৮৯০৯৩, ই-মেইলঃ khoborersomoy24@gmail.com, web: www.khoborersomoy.com